গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় উন্নয়নের এটি এক অপরিহার্য পরিপূরক উপাদান। কারণ গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন ছাড়া জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়ন সম্পূর্ণ হবে না। আর গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য প্রাথমিকভাবে করণীয় হলোÑ গ্রামাঞ্চলের সড়ক অবকাঠমোর উন্নয়ন। সড়ক উন্নত হলে যোগাযোগের সুবিধা হয়, মানুষ পণ্য বিপণনের সুযোগ পায়। অর্থনৈতিক নানা কর্মকাণ্ডে গতি আসে এবং এ কর্মকাণ্ডে মানুষের সংশ্লিষ্টতা বাড়ে। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণের হাত ধরেই সৃষ্টি হয় বাজারঘাট, পরিবহন খাত, কৃষির বৈচিত্র্য। এসব খাতে অধিক মানুষ জড়িত হয়ে উন্নয়নের একটি বিরাট পরিবেশ তৈরি হতে পারে। কিন্তু গত ৫০ বছরে দেশের সরকারগুলো গ্রামীণ উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা কখনোই সেভাবে অনুধাবন করেনি। একমাত্র এরশাদের শাসনামলে স্বয়ংসম্পূর্ণ উপজেলা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে উন্নয়নের অভিমুখ গ্রামীণ এলাকায় সম্প্রসারণের একটি বাস্তব কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল। সেটিও পরবর্তী সরকারগুলো অনুসরণ করেনি।
আওয়ামী লীগ সরকারও উন্নয়নে গ্রামাঞ্চলকে গুরুত্ব দেয়নি কখনো। এমনকি আইলা, সিডরের তাণ্ডবে ভেঙে যাওয়া উপকূলীয় বেড়িবাঁধ মেরামত বা পুনর্নির্মাণের যে স্বাভাবিক দায়িত্ব সরকারের ওপর ছিল সেই ন্যূনতম দায়িত্বও গত এক যুগে সুনজর পায়নি এই সরকারের। এখন প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ সড়কের বিষয়ে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরির নির্দেশনা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এই নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের পল্লী অঞ্চলে কী পরিমাণ রাস্তা এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে, আর কত রাস্তা তৈরি করতে হবে এবং কোন কোন সংস্থা কোন কোন রাস্তা তৈরি করবে এসবের বিস্তারিত থাকতে হবে মহাপরিকল্পনায়।’ তিনি বলেছেন, ‘গ্রামীণ এলাকায় যেসব উন্নয়ন হচ্ছে, রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হচ্ছেÑ সেগুলো মানসম্পন্নভাবে হচ্ছে কি না তা মনিটরিং করতে হবে। সেগুলো সঠিকভাবে হচ্ছে কি নাÑ তা খেয়াল রাখতে হবে। এসব রাস্তা মানসম্মতভাবে করতে হবে। রাস্তায় যাতে পানি জমে না থাকে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।’ তা ছাড়া, রাস্তায় ব্যবহৃত বিটুমিনের মানও নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
একটি রাস্তা তৈরি করা হলে কী কী বিষয় খেয়াল রাখতে হবে সেটিও প্রধানমন্ত্রীকে বলে দিতে হচ্ছেÑ এটি শুনে কেউ হয়তো হাসতে পারেন, কিন্তু এর পেছনে দুঃখজনক বাস্তবতা আছে। ঢাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণের মতো মেগা প্রকল্পের নকশা করতে দিয়ে আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা ভুলে যান, বাংলাদেশের সব গাড়ি ডান হাতে চালিত এবং সেটি নকশাকারীকে জানানোর দরকার আছে। এ কারণে মগবাজার ফ্লাইওভারের নকশা ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে, যা সারানোর কোনো উপায় পাওয়া যায়নি। সুতরাং সড়ক তৈরি করলে তা যেন যথেষ্ট প্রশস্ত করা হয়, তাতে যেন পানি জমে না থাকে, বিটুমিন যেন মানসম্মত হয়, সেগুলো বলে দেয়ার দরকার তো আছেই। যাই হোক, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা তৈরিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক পদক্ষেপ।
২০১৫ সালেও এডিবির অর্থায়নে পল্লী সংযোগ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৯০০ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ করা হয়। ২০১৮ সালে ৩৪ প্রান্তিক জেলার রাস্তাঘাট সব মৌসুমে চলার উপযোগী, জলবায়ু সহিষ্ণু ও নিরাপদ করতে ২০ কোটি মার্কিন ডলার দেয় সংস্থাটি। সেসব প্রকল্প গ্রামের মানুষের জন্য যথেষ্ট উপকারী। মূলত অপর্যাপ্ত গ্রামীণ পরিবহন ব্যবস্থা এবং দুর্বল বাজার অবকাঠামো বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নিয়মিত বন্যা এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগও নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নের পথে গুরুতর বাধা। এসব কারণে কৃষিপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে। আমাদের দরকার এমন গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ করা, যেগুলো সব মৌসুমে চলাচলের উপযোগী হবে। তাহলে গ্রামের একজন কৃষক তার পণ্য দ্রুত ও সহজে বাজারে সরবরাহ করতে পারবেন। নারী এবং শিশুরা যেকোনো আবহাওয়ায় সহজে ও নিরাপদে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামাজিক পরিষেবা গ্রহণের সুযোগ পাবে। একমাত্র সড়ক অবকাঠামোই গ্রামীণ জীবনযাত্রার পুরো দৃশ্যপট পাল্টে দিতে পারে। সুতরাং এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সঠিক জায়গায় আলো ফেলেছেন।
Leave a Reply